আমাদের মানসিক ভয়

প্রত্যেক শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য দরকার প্রফুল্ল মন ও সতেজ শরীর। আর এর জন্য দরকার খেলাধুলা এবং পরিবারের লোকজন ছাড়াও বন্ধুদের সাথে ইতিবাচক গল্প ও নির্মল মেলামেশার সুযোগ।
বর্তমানে করোনা ভাইরাস এর জন্য আমরা সবাই ঘরবন্দী। মার্চ, ২০২০ থেকে যখন স্কুল বন্ধ তখন খেলার মাঠ, বাসার নিচে ও ছাদে বাচ্চাদের চলাচলও আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা বড়রা এখন আমাদের কাজ করছি– অফিসে-বাজার যাচ্ছি, বন্ধুবান্ধব অনেকের সাথে কথাবার্তা বলছি এবং কারও কারও সাথে দেখাও হচ্ছে।
বলা যায় আমাদের জীবন বেশ কিছুটা স্বভাবিক হয়ে ওঠেছে। তারপরও আমরা বড়রা কিন্তু মানসিকভাবে ভীত করোনা ভাইরাস নিয়ে।
আমরা আমাদের শিশুদের বলি, চারদিকে করোনা ভাইরাস– এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। তাহলে শিশুরা কি করবে? করোনা-কালে আমাদের শিশুদের মানসিক বিকাশ কি আটকে থাকবে? এটা হতে পারে না– হতে দেয়া যায় না। সেজন্য শিশু-কিশোরদের নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে এবং বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।

শিশু-কিশোরদের জন্য আমাদের করণীয় :

১) শিশু-কিশোররা টিভিতে ‘করোনা’বিষয়ক যত রকম খবর দেখে-শুনে, তা তারা যেভাবে সহজে বুঝতে পারে, সেরকম করে তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। যাতে তারা সঠিক তথ্যসহ বিষয়টি স্পষ্ট করে বুঝতে পারে।

২) শিশু-কিশোররা যখন ‘করোনা’- নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন করবে, তার উত্তর আমাদের এমনভাবে দিতে হবে যাতে সঠিক বিষয়টি তাদের বোধগম্য হয়। যদি উত্তর জানা না থাকলে সত্য কথাই বলতে হবে যে, আমি জানি না এবং পরে সঠিক উত্তর জেনে তা শিশুদের জানাতে হবে।

৩) শিশু-কিশোরদের প্রশ্ন খুব মনোযোগ দিয়ে ভালো করে শুনতে হবে এবং এটা বুঝাতে হবে যে, তাদের প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবং উত্তরটি সহজ ও সুন্দর ভাষায় দিতে  হবে। শিশু-কিশোরদের এটা বোঝাতে হবে যে, অবিভাবকরা তাদের প্রশ্নকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।

৪) শিশুদের প্রশ্ন খুব ভালো করে বোঝার জন্য দরকার হলে বার বার জিজ্ঞেস করতে হবে তারা কি জানার চেষ্টা করছে এবং এই প্রশ্নটি নিয়ে তারা কি চিন্তা করছে– কিভাবে চিন্তা করছে।

৫) তাদের সাথে কথা বলার সময় প্রসঙ্গক্রমে একথাও বুঝিয়ে দিতে হবে বাবা অথবা মা’র যদি  কিছু হয় তবে, কে বা কারা তাদের দেখাশোনা করবে।

৬) শিশু-কিশোরদের সাথে প্রয়োজনীয় সব বিষয়ে কথাবার্তা বলতে হবে। যেমন– কেন সব সময় এবং সব জায়গায় স্বাস্থ্য-বিধি মেনে চলতে হবে এবং  কিভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, রাস্তা-ঘাটে, বাড়িতে স্বাস্থ্য-বিধি মেনে চলতে হবে।

৭) করোনা ভাইরাস সম্পর্কে শিশু-কিশোরদের ভালোভাবে অবহিত করতে হবে– কথা বলা ছাড়াও  ভিডিও ছবি বা কার্টুন-এর সাহায্য নিতে হবে।

৮) শিশু-কিশোরদের সাথে কথাবার্তা বলতে হবে, তাদের উৎসাহিত করতে হবে সঠিক খবর দেখার জন্য। তারা সারা দিন ইন্টারনেট চালায়, তাদের বুঝাতে হবে ইন্টারনেট চালানোটাই বড় কথা নয়, বড় কথা কোন খবরটা কোন মাধ্যম থেকে এসেছে এবং কোন খবরটা সঠিক।

 ৯) শিশু-কিশোরদের চেহারা দেখে বোঝার চেষ্টা করতে হবে কখন তারা ভয় পাচ্ছে বা চিন্তিত হচ্ছে। এসব নেতিবাচক বিষয়গুলো বের করে আনার জন্য তাদের সাথে সত্য বলুন ও বোঝানোর চেষ্টা করুন যাতে পরবর্তী সময়ে এই বিষয় নিয়ে তারা ভয় না পায়।

১০) করোনা ভাইরাস এর কারণে বিশ্ব এখন স্তব্ধ। শিশু-কিশোররাও মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে পারিপার্শিক চাপে এবং তাদের প্রতি আমাদের পূর্ণ মনোযোগিতা না থাকার কারণে। তাদের প্রয়োজনীয় আনন্দ ও বিনোদন দেবার চেষ্টা করুন এবং আশাবাদী রাখুন– তাদের বলুন, সময়ের সাথে সাথে সামনের দিনগুলো স্বাভাবিক হয়ে যাবে ।

৪ থেকে ৫ বছরের শিশুদের সমস্যা :

১) প্রত্যাবর্তনশীল আচরণ যেমন আঙ্গুল চুষা, হামাগুড়ি দেয়া, বিছানায় পেশাব করা।

২) অনির্ধারিত অথবা অনির্দিষ্ট ভয় এবং সাধারণ উদ্বেগ কাজ করে। 

৩) খাবার রুচি কমে যাওয়া এবং কম ঘুমানো ও ভয়ের স্বপ্ন দেখা।

৪) চিন্তা, হাহাকার , অনড় জেদ (যা শিশুদের মানসিক ভাবে দুর্বল করে দেয়)। 

৬ থেকে ১১ বছরের শিশুদের সমস্যা :

১) একই খবর প্রতিদিন, একই চিন্তা। 

২) অনির্ধারিত অথবা অনির্দিষ্ট ভয় কি হবে আমাদের?

৩) মেজাজ খিট্খিটে অথবা তীব্র রাগী আকার ধারণ করতে পারে।

৪) দৈনন্দিন জীবনে খামোকা রাগারাগি, কথা না শোনা, নিয়ম ভাঙা, পড়াশোনা না করা।

৫) খাবার ও ঘুমের কোনো সঠিক সময় রক্ষা না করা।

৬) সব কাজে অমনোযোগী ও খামখেয়ালিপনা এবং কোনো কাজ না করা। 

১২ থেকে ১৮ বছরের কিশোরদের সমস্যা :

১) প্রতিদিন একই খবর, একই চিন্তা, একই প্রশ্ন মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।

২) অতিরিক্ত চিন্তা তাদের আতংকগ্রস্ত করে ফেলে।

৩) ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয় সঠিক ভাবে কাজ করার ক্ষমতা।

৪) অনেককেই দেখা যায় ঠিক ভাবে কাজ সম্পন্ন করে কিন্তু তারা জোর করে কাজ করে।

৫) ক্রোধ ও রাগের কারণে অনেকে মারপিট করে। 

৬) সব রকম নিয়ম-আইন না মানার প্রবণতা দেখা দেয়। 

৭) মানসিকভাবে তারা মানতে চায় না : কেন? কিভাবে? কি হবে?

৮) ভয়ের কারণে কেউ কেউ অনেক বেশি অথবা কম খাচ্ছে। 

  আমাদের নিশ্চিত করতে হবে– প্রথমে অভিভাবকদের তারপর শিশুদের– তাদের জীবনে করোনা ভাইরাস এর কারণে অনেক রকম পরিবর্তন এসেছে, পরিবর্তনগুলো সাধারণভাবে মেনে নেয়া, আস্তে আস্তে মানসিকভাবে মানিয়ে নেয়া ও শিশুদের কথাবার্তা বলে খেলার ছলে বুজঝয়ে মানিয়া নেয়া। ‘সঠিক’ বা ‘ভুল’ বলে কোনও পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া নেই– সকল মানুষের বিশেষ করে শিশুদের নিজস্ব পদ্ধতিতে কঠিন চাপের সময় নিজস্ব আবেগ দেখায়। শিশুরা নিজেদের খাপ খাওয়ায় তাদের নিজস্ব গতিতে– কেউ আগে আর পরে।

  শিশুরা যখন প্রাকৃতিক চাপের মুখে পরে, তাদের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হয় বড়দের থেকে। শিশুদের রূপ খুব শীঘ্রই বদলায়।  তারা খুব তাড়াতাড়ি যেমন খুশি হয় তেমনি অসন্তুষ্ট প্রকাশ করে । শিশুরা বেশির ভাগ সময় মনের ভাব প্রকাশ করে ছবি এঁকে ও খেলার মাধ্যমে এবং বড়রা খুব কম সময়ই তা লক্ষ্য করে। অভিযোজন বা শরীরকে ও মনকে মানসিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে সময় প্রয়োজন। শিশুরা সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে নীরব মনে কোথায় কি হচ্ছে। তারা ভাবে, চিন্তা করে, বিবেচনা করে তারপর সেটা গ্রহণ করে। এই রকম সমন্বয়কারী শিশুরা হয় সহনশীল ও শক্তিশালী মনোবলের  অধিকারী।

অতিরিক্ত যত্ন নিতে হবে শিশুদের মানসিক বিকাশে জন্য :

১) যে সকল পরিবার পছন্দ করে না শিশুদের সামনে বর্তমানে করোনা সমস্যা আলাপ করা।

২) যে সকল শিশুদের মানসিক বিকাশ কম ও অন্য সাধারণ শিশুদের থেকে ধীর গতি ও দুর্বল। 

৩) যে সকল শিশু বাবা ও মা এর বিচ্ছেদ, মৃত্যু, অসুস্থতা দেখেছে।

৪) যে সকল শিশু মানসিক ব্যাধি অথবা পরিবারে কারো আছে তাদের।

অভিভাবকরা যেগুলো থেকে বিরত থাকবেন:

১) পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হবে– একথা সরাসরি বলা যাবে না, বলতে হলে ধীরে ধীরে গল্পের মাধ্যমে বলতে হবে।

২) ঘনিষ্ট আত্মীয় কিংবা শিশুর পরিচিত কারো কিছু হলে তাৎক্ষণিক না বলে, খেলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বলতে হবে।

৩) হতাশা বা একঘেঁয়েমি ভাব শিশুদের বুঝতে দেয়া যাবে না।

৪) ভাইরাস সম্পর্কে অপর্যাপ্ত বা  ত্রুটিযুক্ত তথ্য শিশুদের বলা যাবে না।

৫) পরিবারের কেউ দূরে অথবা অসুস্থ থাকলে তা মনে করিয়ে দেয়া যাবে না।

৬) করোনা কালে আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও পারিবারিক সমস্যা শিশুদের সামনে আলাপ করা যাবে না, এতে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধা প্রাপ্ত হয়।

অবিভাবকদের করণীয়

১) শিশুদের সুযোগ দেয়া উচিত তাদের মনের ভাব প্ৰকাশ করার সেটা মনোরম অথবা অপ্রীতিকরও হতে পারে।

২) অনেক সময় খবর শোনার পরে শিশুরা নীরব থাকতে পারে, তাদের চাপ দেয়া যাবে না কথা বলার জন্য। 

৩) শিশুরা এখন মনোরম অথবা অপ্রীতিকর ভাব প্রকাশ করতে পারে যে কোনো বিষয়ে, কারণ তারা করোনা ভাইরাস নিয়ে মানসিক চাপে আছে।

৪) শিশুদের সঠিক শিক্ষা দিতে হবে কোন খবর শুনে কি রকমভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে হয়, তা না হলে সঠিকভাবে মাপা যাবে না শিশু কিভাবে সবকিছু গ্রহণ করছে।

৫) শিশুদের বুঝতে দিতে হবে অভিভাবকরা তাদের কত ভালোবাসে এতো বিপদের সময়েও।

সঙ্কটের সময়ে মানসিক সুরক্ষা বোধ প্রতিষ্ঠা করা :

১) আমাদের প্রতিদিন এর কার্যক্রম পরিবর্তন হয়েছে এতে শিশুরা মানসিকভাবে ভীত।

২) অভিভাবকদের উচিত প্রতিদিন শিশুদের সময় দেয়া যেমন একসাথে খেলা (লুডো, কেরাম), টিভি দেখা ও ছবি দেখা। 

৩) বাসার প্রতিদিনের নিয়ম ঠিক রাখা যেমন সময় মতো ঘুম থেকে ওটা, গোসল, তিন বেলা খাবার সময়।

৪) অপ্রীতিকর খবর ও অনুষ্ঠান শিশুদের দেখানো উচিত নয়, দেখাবেন যেগুলো তাদের মানসিক আনন্দ দেবে।

৫) অভিভাবক যদি বাড়ি থেকে বের হয় তবে শিশুদের অবগত করে যেতে হবে কোন সময় বাসায় ফিরবে। এতে শিশুরা মানসিকভাবে ভীত হবে না।

শিশুদের অন্তর্নিহিত এবং স্পষ্ট প্রতিক্রিয়াগুলো ভালোভাবে বোঝা :

১) আচরণ পরিবর্তন এবং প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা।

২) শিশুদের বুঝাতে হবে বিশদভাবে কেন সমস্যা হচ্ছে।

৩) শিশুদের আচরণ পরিবর্তন হলে বুঝিয়ে সেটা ঠিক করতে হবে।

৪) অভিভাবকদের উচিত সময় দিয়ে শিশুদের কথা শোনা, অনেক সময় বাক্যের ভুল অর্থ মনে করে ভুল বুঝে, তখন সময় দিয়ে ভালো করে শিশুদের বুঝাতে হবে।

শিশুদের অনুভূতিগুলিকে অর্থ প্রদান এবং প্রকাশ করতে সাহায্য করা :

১) শিশু ভালো মন্দ যাই বলুক, তাকে বলার জন্য উদ্ভুত করা।

২) শিশুদের মন্দ অভ্যাসগুলো ভুলাতে হবে আস্তে আস্তে খেলার ছলে ও নতুন ভালো কিছু শেখাতে হবে।

৩) শিশুদের শেখাতে হবে সবকিছু ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা ও হিংস্রতা নিয়ন্ত্রণ করা। 

৪) সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতির অনুভূতি, বিশেষত দুর্বল জনগোষ্ঠীর (বয়স্ক, অসুস্থ, অক্ষম) দিকে আরও সহানুভূতিশীল অনুভূতি দেখানো দরকার।

৫) শিশুদের সবসময় স্নেহ দিতে হবে এবং অভিভাবকদের নিজেস্ব সমস্যা ও মানসিক চাপের কথা শিশুদের বলা যাবে না।

মানসিক ভাবে শক্তিশালী ও পালিত আশা জোরদার করা :

১) শিশুদের প্রাধান্য দিতে হবে পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেবার সময়। 

২) শিশুদের স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিতে হবে নিজের কাজ করার জন্য, যেমন নিজের ঘর গুছানো, নিজের কাপড় পড়া ও গোসল করা।

৩) শিশুদের উৎসাহ দিতে হবে দৈনন্দিন কাজ ঠিক মতো করা এবং অনলাইন ক্লাস করার জন্য।

অভিভাবকদের নিজস্ব দায়িত্ব স্বীকার করতে হবে :

১) অভিভাবকদের প্রথমেই পরিবর্তিত পরিবেশে  নিজেদের খাপ খাওয়াতে হবে ।

২) তাদের উচিত শিশুদের চাহিদা যথাসাধ্য মেটানোর চেষ্টা করা।

৩) সারাদিনের কাজ-কর্ম পাশাপাশি শিশুদের উপর নজরদারিটাও তাদের করতে হবে।

৪) তাদের উচিত শিশুদের সামনে প্রয়োজন অনুযায়ী অন্যদের সাহায্য নেয়া, তাহলে শিশুরাও প্রয়োজনে অভিভাবকদের কাছে সাহায্য চাইবে।

শিক্ষকের ভূমিকা

১) সকল শিক্ষাবিষয়ক বিষয়বস্তুকে নতুন করে অনলাইন শিক্ষার বিষয়বস্তুতে রূপান্তরিত করতে হবে।

২) নতুন অনলাইন শিক্ষার বিষয়বস্তু শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলবে, অনভিজ্ঞ  শিক্ষার্থীদের খাপ খাওয়াতে সমস্যা হবে বা সময় লাগবে।

৩) অনেক শিশু কম্পিউটার অথবা ক্যামেরা এবং নতুন শিক্ষা-উপকরণ ঘাবড়ে যেতে পারে, এই সম্ভাবনা সামনে রেখে শিক্ষা দিতে হবে।

৪) শিক্ষাথীদের প্রশ্ন ও তাদের সমস্যা শিক্ষকদের খুব ভালো করে শুনতে হবে।

৫) অনলাইনে পড়াবার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন অযথা সময় নষ্ট না হয়।

৬) পড়াশুনার বিষয় খুব সহজ ভাষায় দিতে হবে, কারণ শিক্ষার্থীরা সবাই স্মার্টফোন অথবা কম্পিউটার ব্যবহার করবে।

৭) অনলাইনে পড়াবার সময় শিক্ষার্থীদের কথা বলার সুযোগ দিতে হবে, তাদের কথা বুঝতে হবে তারপর সঠিক ভাবে উত্তর দিতে হবে, কারণ অনলাইন পড়াশোনা তাদের জন্য নতুন একটি পদ্ধতি। 

৮) শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস নেবার পাশাপাশি পড়াশোনার বিষয়গুলো আরো বিস্তারিতভাবে ভিডিও করে সবাইকে বিতরণ করতে হবে।

৯) প্রতি ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের করোনা ভাইরাস সম্পর্কে যথাযথ পরামর্শ দিতে হবে।

১০) আজকে যা পড়ানো হলো, পড়া শেষে তা আবার কিছুক্ষণ আলোচনা করতে হবে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাতে তারা সাচ্ছন্দ বোধ করে।

১১) প্রতিদিন পড়াশুনার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশে কি হচ্ছে, সে বিষয়েও সাধারণ আলোচনা করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের একঘেঁয়েমিতে পেয়ে না বসে।

১২) শিক্ষার্থীরা শ্রেণী কক্ষে ক্লাস করে এবং স্কুলের মাঠে ছুটাছুটি ও খেলাধুলা করে অভ্যস্ত। অনলাইন ক্লাসে সেই পরিবেশের কিছুই না থাকায় অনেক সময় তারা মানসিক চাপে ভুগতে পারে এবং তাদের আচরণ স্কুলের ক্লাস চলাকালীন সময়ের মত না-ও হতে পারে।

১৩) শিক্ষাথীরা তাদের এলাকায় যা যা দেখছে এবং শুনছে, অনলাইন ক্লাসে অনেকে সেসব ব্যাপারে অনেক কথা বলতে চেষ্টা করবে। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে  শিক্ষকদের সারবত্তাসূচক একটি সুন্দর একটি ব্যাখ্যা দিতে হবে, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে সহায়ক হতে পারে।

১৪) শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে, যাতে তাদের মধ্যে অর্থহীন ও অসহায় মানুষদের সাহায্য করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

১৫) প্রতিটি অনলাইন-ক্লাস শেষে শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের সাবধানে থাকার জন্যে উপদেশ দেয়া এবং কাউকে পড়াশোনার জন্য স্বাভাবিক ক্লাসের মত চাপ না দেয়া ও এটা করা উচিত ছিল, এটা করতে হবে– এরকম বলাও ঠিক হবে না। 

১৬) প্রতি ক্লাস সেশন একঘন্টার বেশি করা যাবে না। প্রথম ৩০ মিনিট সবাই মনোযোগ দেবে তারপর ৩১ – ৩৫ মিনিট অর্থাৎ ৫ মিনিট একটু সবাই গল্পে ও কে কেমন আছে এবং তারপর ৩৬ – ৫৫ মিনিট আবার ক্লাস আর শেষের ৫ মিনিট সবার প্রশ্ন-উত্তর পর্ব। 

১৭) অনলাইন ক্লাসে শিশুরা শিক্ষার বিষয়বস্তু বুঝবে কিন্তু কোনো কিছু মুখস্ত ও দরকারি পাঠ মনে রাখতে পারবে না, কারণ তারা বন্ধ ক্লাস রুমে নেই, তাদের মনোযোগ নানান দিকে থাকবে।

স্মার্টফোন একমাত্র গ্যাজেট যার সাহায্যে বর্তমানে শিশুরা খুব সহজে গেমস, ছবি ও ভিডিও কল করছে। স্মার্টফোন দিয়ে শিশুরা স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করে অনলাইন ক্লাস করার জন্য। বেশিরভাগ সময়ে দেখা যায় ৮ বছরের নিচের শিশুরাও দিনে ২ থেকে ৪ ঘন্টা স্মার্টফোন ও ট্যাবলেট চালায়। এর ফলে শিশুদের টিভি ও চ্যানেলের প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে কারণ যেটা খুশি সেটা তারা দেখতে পারে ইউটিউব এর মাধ্যমে।

জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে ৬ – ১২ বছরের শিশুরা (৯৬%) মোবাইলে ইন্টারনেট ও ইউটিউব চালায়।এদের মধ্যে ৮০% শিশু ইউটিউব চালায় প্রতিদিন এবং ৬৫% শিশু ইউটিউব চালায় দিনে যখনি সময় পায়। ৩ -৪ বছরের শিশুরা ইউটিউব চালায় কার্টুন দেখার জন্য আর ৪ – ৭ বছরের শিশুরা ইউটিউব চালায় নানা প্রকার বিনোদনমূলক প্রোগ্রাম দেখার জন্য। ইউটিউব-এ নানা রকম প্রোগ্রাম রয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, শিশুরা শিক্ষামূলক ভিডিও দেখে ৬৪%, জীব-জানোয়ার এর ভিডিও দেখে ৪৬%, নতুন পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখে ৩৪%। 

৮ – ১৩ বছরের শিশুরা অভিভাবকদের অনুপস্থিতিতে ইউটিউব এ নানা রকম অশালীন ঘেঁষা ভিডিও দেখে। তাই অভিভাবকদের উচিত শিশুদের আশেপাশে থাকা ও তাদের লক্ষ্য রাখা, তারা কি ভিডিও দেখছে। অভিভাবকদের দারোয়ান হিসেবে কাজ করতে হবে, যখন শিশুদের হাতে স্মার্টফোন থাকে। ৭৪% অভিভাবক তাদের শিশুদের মোবাইলে ইউটিউব চালানোর অনুমতি দিয়ে থাকেন। ৪৩% শিশু (৬ – ১২ বছর) তাদের  অভিভাবকদের সাথে বসে ইউটিউব দেখে ।

ইন্টারনেট ভিডিও ও সোশ্যাল এপ্লিকেশন:

বাড়ন্ত শিশু ও কিশোররা সময়ের সাথে সাথে অনলাইন ভিডিও ও সোশ্যাল এপ্লিকেশনগুলোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে।  বাড়ন্ত শিশু ও কিশোররা দিনের তিন ভাগের এক ভাগ সময় আবার কিছু কিছু শিশু ও কিশোর দিনের অর্ধেক-এর বেশি সময় ব্যয় করে অনলাইন ভিডিও ও সোশ্যাল এপ্লিকেশনগুলোর পিছনে।   বেশির ভাগ পরিবারে দেখা যায়, অভিভাবকরা যখন ব্যস্ত থাকে তাদের নানাবিধ কাজ নিয়ে তখন বাড়ন্ত শিশু ও কিশোররা ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্মার্টফোন-এ অনলাইন ভিডিও ও সোশ্যাল এপ্লিকেশন গুলোর সাথে কারণ অভিভাবকরা সময় দিতে পারেন না শিশুদেরকে। অনেকে শিশুদের খাবার সময় স্মার্টফোন-এ অনলাইন ভিডিও দিয়ে ব্যস্ত রাখে যাতে শিশু তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়। এতে শিশুদের অভ্যাস খারাপ হয়ে যায়।  অনেক পরিবারে একটি শিশুর জন্য একটি স্মার্ট টিভি বরাদ্ধ করে রাখা হয়, যা তার মানসিক বিকাশকে পুরোপুরি অসুস্থ করে দেয়। ১০ – ১৩ বছরের বাড়ন্ত শিশু ও কিশোররা সোশ্যাল এপ্লিকেশন যেমন ফেইসবুক ব্যবহার করে। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায়, অভিভাবক জানে না যে, তার শিশু ফেইসবুক ব্যবহার করে। আবার এমনও দেখা যায়, অনেক অভিভাবক নিজেরাই শিশুদের ফেসবুক একাউন্ট খুলে দেয়।  অনেক শিশু আবার স্কাইপি ব্যবহার করে ভিডিও ও মেসেজ পাঠানোর জন্য।  অনেক পরিবার বাসায় ইন্টারনেট উন্মুক্ত করে রাখে, ফলে বাড়ন্ত শিশু ও কিশোররা কম্পিউটার ও স্মার্টফোন দিয়ে অনলাইন গেম খেলে, যা তাদের বয়েসিদের জন্য নয়, কিন্তু বাড়ন্ত শিশু ও কিশোররা বয়স বাড়িয়ে মিথ্যা ডাটা দিয়ে গেম খেলে। বাড়ন্ত শিশু ও কিশোররা অতিমাত্রায় অনলাইন গেম, অনলাইন ভিডিও ও সোশ্যাল এপ্লিকেশন চালানোর ফলে তারা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অনেকে সঠিক নিয়ম বা বিধি-বিধান মেনে চলতে ব্যর্থ হয়, অতি মাত্রায় ক্রোধ সৃষ্টি হয় মনে, পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যায়।

বাড়ন্ত শিশু ও কিশোর এবং অভিভাবকের করণীয় :

আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। আপনার শিশুকে আপনারই লালন-পালন করতে হবে এবং সঠিকভাবে ভবিষ্যতের জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য শিশু-কিশোরদের কিভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন আপনার শিশুকে, সেজন্য নিচের প্রশ্নগুলো বিবেচনা করতে হবে :

১) আপনার সন্তান কি একা একা ঘরের এক কোণে বসে মোবাইল ব্যবহার করে?

২) মোবাইল ব্যবহার করাকালীন কাউকে দেখে চমকে উঠে?

৩) মোবাইল ব্যবহার করাকালীন কাউকে দেখলে মোবাইল বন্ধ করে দেয়?

৪) দিনের অধিক সময় মোবাইল ব্যবহার করে?

৫) রাতে একা একা মোবাইল ব্যবহার করে?

৬) বাথরুমে মোবাইল ব্যবহার করে?

৭) কেউ মোবাইল ধরলে রাগারাগি করে?

৮) মোবাইল লক করে রেখে দেয়?

৯) অনলাইন ক্লাস এর নাম করে সারা দিন মোবাইল চালাচ্ছে কি না?

এই সব প্রশ্নের জবাব ইতিবাচক হলে আপনার সন্তানের মোবাইল ব্যবহার নিয়ে অর্থাৎ মোবাইল দিয়ে সে আসলে কি করছে, এব্যাপারে  আপনাকে সতর্ক হতে হবে।

আপনার বাড়ন্ত সন্তান কি করছে, যদি উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখেন, তা হবে শিশুদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন, যা আপনার শিশু-কিশোর কখনোই আপনার কাছে আশা করে না।

বাড়ন্ত শিশু ও কিশোররা সবসময় মনে করে বাবা-মা তাকে ১০০% বিশ্বাস করে। কখনো যদি শিশু-কিশোরদের মনে হয়, তাদের বাবা-মা তাদের বিশ্বাস করে না, তাহলে শিশুরা আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগে, এটা দীর্ঘ দিন চলতে থাকলে তারা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।   আপনার বাড়ন্ত সন্তান এর সাথে সব সময় বন্ধুর মতো আচরণ করুন– তার সাথে সময় দিন, তার মানসিক ভাব-সাব বোঝার চেষ্টা করুন– সে কি চিন্তা করছে, কি করতে চায় এবং কেন করতে চা? শিশুকে চাপ দিয়ে কোনো কাজ করানো যায় না। শিশুর ‘না’-কে সুন্দরভাবে ‘হা’করানো যায় একমাত্র আদরের মাধ্যমে।

সমাধান কি ?

১) যদি বাসায় কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপ থাকে তবে শিশুদের বড় পর্দার কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপ দিন, যদি না থাকে তবে স্মার্টফোন দিন।

২) বাড়ির এমন জায়গায় কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপ রাখবেন, যেখানে বাসার সবার সমাগম থাকে এবং সবার চোখে থাকে– কম্পিউটার এর পর্দায় কি হচ্ছে।

৩) আপনার সন্তানদের সাথে ফেইসবুক এ আপনি বন্ধু হিসেবে থাকুন।

৪) সন্তানদের দুই একদিন পর পর জিজ্ঞাস করুন তার বন্ধুরা কেমন আছে  এবং আপনার সন্তান তাদের সাথে কিভাবে যোগাযোগ করছে। এতে আপনার ও সন্তানের ভেতর এক ধরণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হবে।

৫) মাঝে মাঝে সন্তানের পোস্ট-এ একটু কমেন্ট করবেন এবং দেখবেন তার অনলাইন কার্যবিধি। যদি দেখেন সে ভুল করছে তবে তাকে বন্ধুসুলভ কথায় বুঝাতে হবে সে যে, এই কাজ তার ভবিষতের জন্য খুবই ক্ষতির কারণ হবে, তাই এসব কাজ যেন আর না করে।

৬) আপনি বাসায় এসব ব্যাপারে কঠিন নিয়ম বলবৎ করলে আপনার সন্তান বাইরে গিয়ে আপনার অজান্তে অন্য কারো মোবাইল থেকে অথবা কম্পিউটার থেকে ফেইসবুক ও অন্য সোশ্যাল এপ্লিকেশন চালাবে। এখন বিশ্ব অনেক কাছে, ঘর থেকে বের হলে বন্ধুদের কাছ থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়।

৭) সন্তান বেশি ছোট হলে তার কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও স্মার্টফোনে পেরেন্টস রেস্ট্রিকশন মোড দিয়ে এক্টিভেট করে রাখবেন। ওয়াইফাই থাকলে ফায়ারওয়াল দিয়ে বাজে সাইট বন্ধ করে দিতে হবে, সন্তান যেন বুঝতে না পারে।

৮) আপনি সন্তানকে বাসায় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেন না, কিন্তু সে পাশের বাড়ির ওয়াইফাই ব্যবহার করছে কি না সেটা মাঝে মাঝে লক্ষ করুন।

৯) যদি স্মার্টফোনে বেশি গেম খেলে তবে তাকে ল্যাপটপ অথবা কম্পিউটার দিন খেলার জন্য, কারণ মোবাইলের পর্দা অনেক ছোট এবং এতে তার চোখের ক্ষতি হবে।

১০) অনলাইন ক্লাস করার সময়  কিংবা পড়াশোনার সময় যদি কম্পিউটার অথবা ল্যাপটপ থাকে তবে স্মার্টফোন ব্যবহার না করা ভাল। 

আমাদের সন্তান সৃষ্টিকর্তার দান, সঠিকভাবে তাদের লালন-পালন এবং পরিচর্যা করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। এখন করোনা ভাইরাস এর কারণে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই মানসিকভাবে নাজুক ও দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। এই সময়ে অভিভাবকদের খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ আমাদের সন্তানরা নতুন প্রজন্মের ডিজিটাল যুগের।

তারা আমাদের চোখমুখ দেখেও বুঝতে পারে আমাদের সুবিধা ও অসুবিধার কথা। আমাদের জীবনে নানা রকম সমস্যা আছে এবং থাকবে, কিন্তু অভিভাবক হিসেবে আমাদের উচিত ধৈর্য ধরে সন্তানদের সুবিধা-অসুবিধা ও সমস্যার কথা শোনা এবং সব সময় যতদূর সম্ভব নরম মেজাজে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পড়াশোনাসহ প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ের সমাধান এমন করে দেয়া, যাতে তারা সেটা মনের থেকে মেনে নিয়ে কার্যকরভাবে অনুসরণ করতে পারে।

সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে নিম্ন লিখিত বই ও জার্নাল হইতে :

1) COVID-19 Anxiety – (Self) Management and Adjustment Guide by ACS Athens American Community School.
2) Smartphone Learning for Kids education by Ehlem Zigh, Ayoub Elhoucine, Abderrahmane Mallek, Mohammed Kadiri, Kouninef Belkacem, Tolga Ensari.
3) Youtube & Young Children: Research, Concerns and New Directions by Burcu Izci, Ithel Jones, Tuğba Bahçekapılı Özdemir, Latifa Alktebi, Eda Bakir.
4) Crianças, famílias, e tecnologias. Que desafios? Que caminhos? By Rita Brito e Patrícia Dias.

অনুবাদ ও লেখা: রাজিবুল আনাম
আনাম রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস
এই নিবন্ধটি সবার জন্য উন্মুক্ত এবং বিনামূল্যে বিতরণের জন্য।